
বাংলাদেশ–ভারত ফুটবল ম্যাচে গ্যালারিতে লাল–সবুজ সাজে সেজে ওঠা এক মার্কিন পরিবারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল ভাইরাল হয়েছে। সাত সদস্যের পরিবার—মা–বাবা আর পাঁচ সন্তান—কারও মাথায় লাল-সবুজ ব্যান্ডানা, কারও গালে আঁকা বাংলাদেশের পতাকা। জেনে অবাক হতে হয়, এই পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেও বাংলাদেশই এখন তাঁদের আপন ঠিকানা।
ভাইরাল ছবির সূত্রে খুঁজে পাওয়া যায় পরিবারের কর্তা জ্যাকব বার্লিনের ফেসবুক পেজ ‘জ্যাকব ভাইয়া’। জানা যায়, জ্যাকব বার্লিন ও জয়া বার্লিন পেশায় কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ও উদ্যোক্তা। ঢাকার গুলশানে জ্যাকবের কাউন্সেলিং সেন্টার আছে। পাশাপাশি ‘অ্যাকশন–জয় এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তাঁরা, যেখানে ফরিদপুরের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তৈরি সামগ্রী যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা হয়।
গুলশানের সেন্টারে গিয়ে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। কালো পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরা জ্যাকব আর সালোয়ার–কামিজ পরা জয়া—দুজনকেই দেখে মনে হয়, যেন বাংলাদেশেরই এক দম্পতি। তেমনি তাঁদের ঝরঝরে বাংলাও।
বাংলাদেশ বনাম হংকং চায়নার ম্যাচে প্রথমবার তাঁরা সপরিবার গিয়েছিলেন। সেই থেকেই মাঠে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন দেখানোর শুরু। ইউরোপিয়ান ফুটবলের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের দলে হামজার উপস্থিতি তাঁদের আরও বেশি আকৃষ্ট করে।
পরিবারের পাঁচ সন্তানের নামও আদর করে রেখেছেন বাংলায়—আনন্দ, হাসি, খুশি, সুখী এবং মিষ্টি। সবাই বাংলা শিখেছে, বাংলা খাবার খায়, আর বাংলাদেশকে নিজেদের ঘর মনে করে।
২০১৩ সালে একটি উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতে এসে টানা ছয় বছর বাংলাদেশে থাকেন জ্যাকব ও জয়া। এরপর ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলেও মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে। করোনা সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূর থেকেই ব্যবসার পরিকল্পনা করেন তাঁরা। অবশেষে ২০২২ সালে পরিবারসহ আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
এখন তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন স্থায়ী কর্মী কাজ করেন। পাশাপাশি ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকার অন্তত পাঁচ শতাধিক নারী তাঁদের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত।
২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয়, ২০১১ সালে বিয়ে। বিয়ের পর নববধূকে নিয়ে জ্যাকব মধুচন্দ্রিমায় এনেছিলেন বাংলাদেশে। প্রথমে দেশটি জয়ার ভালো না লাগলেও ফরিদপুরে যৌনপল্লির নারীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি বদলে যান। মানুষ, সংস্কৃতি আর মায়াবন্ধন তাঁকে বাংলাদেশপ্রেমী করে তোলে।
২০১৪ সালে জ্যাকবের বদলি হয়ে তাঁরা ফরিদপুরে চলে যান। সেখানকার মানুষ, প্রকৃতি, খাবার আর সহজ-সরল জীবনযাপন তাঁদের আরও কাছাকাছি টেনে আনে।
আজও ঢাকায় সন্তানদের স্কুলিং হলেও ছুটিতে তাঁরা ফরিদপুরে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সময় শিশুরাও মুখে ফোটায়—“আমরা বাংলাদেশে ফিরব কবে?”
জ্যাকব–জয়া দুজনেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চান। নাগরিকত্ব পেলে ফরিদপুরে নিজেদের জমিতে একটি বাড়ি বানিয়ে সেখানেই বাকি জীবন কাটানোর ইচ্ছা তাঁদের।
বাংলাদেশ শুধু তাঁদের বাসস্থান নয়—এ দেশে তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন নিজেরা, খুঁজে পেয়েছেন পরিবার ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন।